রহস্যে ঘেরা ‘নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড’

মো. আসাদুজ্জামানঃ

আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা নিষিদ্ধ দ্বীপ ‘নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড’।

অনেকে এই দ্বীপটিতে গিয়ে আর ফেরত আসেননি। কথিত আছে ঐ দ্বীপে নরমাংসভোজীরা বসবাস করে। তাই কোনো বহিরাগতরা সেখানে গেলেই তাদেরকে মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হতে হয়।

দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপের ওয়ানদুর শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে উত্তর সেন্টিনেল। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে এই দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার।
অনুমান করা হয় বিশ্বের শেষ উপজাতি ‘সেন্টিনেলিজ’-দের বাস এখানে।

এই উপজাতি গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ঠিক কেমন, সেই বিষয়ে খুব কম ধারণাই রয়েছে বাইরের মানুষের। যার প্রধান কারণ ওই দ্বীপের দুর্গম প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং উপজাতিদের হিংস্র আচরণ। বছরের পর বছর নজর রেখে তাঁদের সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা করতে পেরেছেন নৃতত্ত্ববিদরা।

জানা গেছে, নিজেদের ঘেরাটোপের বাইরের জগতটা যেমন তাদের কাছে অজানা, তেমনি নিজেদের পরিসীমার বাইরে নাক গলাতেও তারা বিশেষ পছন্দ করে না।

এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে সেন্টিনেলীদের জনসংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ধারণা অনুযায়ী এদের জনসংখ্যা সর্বনিম্ন ৩৯ থেকে ২৫০-এর মধ্যে, এবং সর্বোচ্চ ৫০০ পর্যন্ত। ২০০১ সালে পরিচালিত ভারতের জনপরিসংখ্যানে ৩৯ জন পৃথক ব্যক্তির উপস্থিতি রেকর্ড করা হয় যাদের মাঝে ২১ জন পুরুষ ও ১৮ জন নারী। নিরপত্তাজনিত কারণে এই জরিপটি অনেক দূর থেকে পরিচালনা করা হয়েছিলো ।

এটি সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় ৭২ বর্গকিলোমিটার (১৮,০০০ একর) আয়তনে দ্বীপটির জন্য এটি সঠিক জনসংখ্যা নির্দেশ করে না। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে সংঘটিত ভূকম্পন ও সংশ্লিষ্ট সুনামির ফলে সেন্টিনেলীদের জনসংখ্যা ওপর সৃষ্ট কোনো প্রভাবের কথা জানা যায় না। শুধু এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারা এই দুর্যোগের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছে।

প্রাচীন এই উপজাতিদের পেশা শিকার। সভ্য মানুষের সংসর্গ এদের একেবারেই পছন্দ নয়। প্রায় ৬০ হাজার বছর ধরে সেন্টিনেলিজরা এই দ্বীপের বাসিন্দা। এরা আগুনের ব্যবহার জানে না। শেখেনি চাষাবাদও।

এরা একে অপরের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে, তা তাদের সবচেয়ে কাছের উপজাতির পক্ষেও বোঝা অসম্ভব। মনে করা হয়, এই আদিম মানুষরা আফ্রিকা থেকে এসেছিলেন এই দ্বীপে।

আদিম এই উপজাতির সঙ্গে সভ্য মানুষের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮০ সালে। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল ওই দ্বীপে গিয়ে উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।

উপজাতিদের এক প্রৌঢ় দম্পতি এবং চার শিশুকে তুলে নিয়ে আসেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। তাদের নতুন পোশাক ও খাবার দেওয়া হয়। কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আধুনিক সমাজে মানাতে না পেরে রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাদের।

এই ঘটনার পর সভ্য মানুষদের প্রতি সেন্টিনেলিজদের আক্রোশ কয়েক ডিগ্রি বেড়ে যায়। ১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন চিত্রগ্রাহক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য গিয়েছিলেন সেন্টিনেল দ্বীপে। উপজাতিদের বিষ তীরের ঘায়ে তিনি মারাত্মক ভাবে জখম হন।

নৃতাত্ত্বিক ও ভারতের ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক টি এন পণ্ডিতের নেতৃত্বে সেন্টিনেলদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে বেশকিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে তাঁদেরকে উপহার হিসেবে সমুদ্র সৈকতে খাবার ছড়িয়ে (যেমন: নারকেল) বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করা হয়।

এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেন্টিনেলদের মধ্যে তৈরি বহিরাগতদের সম্পর্কে সৃষ্ট হিংস্র মনোভাব দূর করার চেষ্টা করা হয়। বেশ কিছু সময়ের জন্য ধারণা করা হয়েছিলো অভিযানগুলো ফলপ্রসু হচ্ছে।

কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে বহিরাগতদের সাথে দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত জারাওয়া জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত একইরকম অভিযানে সৃষ্ট বেশ কিছু ধারাবাহিক আক্রমণে কিছু মানুষ প্রাণ হারায়। এছাড়াও নতুন রোগের বিস্তারের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় অভিযানগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

২০০৪ সালে সুনামির পর হেলিকপ্টারে নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ডে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ভারত সরকার। সে ত্রাণ নেওয়ার বদলে তারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। ২০০৬ সালে সেন্টিনেল তীরন্দাজরা তাঁদের দ্বীপে অনুপ্রবেশকারী দুই জন জেলেকে তীর মেরে হত্যা করে।

পরবর্তীতে সেন্টিনেল তীরন্দাজরা মরদেহ উদ্ধারে আসা হেলিকপ্টারটিকেও তীর মেরে হটিয়ে দেয়। তার পর থেকেই ওই দ্বীপের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। নিষিদ্ধ দ্বীপের তকমা এঁটে যায় নর্থ সেন্টিনেলের গায়ে। বিপজ্জনক দ্বীপ হিসেবে পর্যটকরাও ওই দ্বীপের ছায়া মাড়ানো বন্ধ করে দেয়। দ্বীপের চারপাশে তিন ন্যটিকাল মাইল পর্যন্ত সীমানা নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হয়।

সাম্প্রতি মার্কিন পর্যটক জন এলেন চাও নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে গিয়েছিলেন। সেখানে দ্বীপটির আদিবাসীদের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড পুনরায় আলোচোনায় এসেছে।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন অনলাইন ব্লগ

লিখেছেনঃ

মো. আসাদুজ্জামান
প্রাক্তন সহ সভাপতি,
চুয়েট সাংবাদিক সমিতি।