চুয়েট ছাত্রলীগের কালো ইতিহাস; সাধারণ ছাত্রদের শিবির আখ্যা দিয়ে করা হতো অমানবিক নির্যাতন

আসহাব লাবিব:

সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকার পতনের পর আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের করা বিভিন্ন কুকর্ম সাধারণ মানুষের সামনে আসছে। ক্ষমতা বলে চাপা পড়ে যাওয়া কিছু ঘটনা আবারো আলোড়ন জাগাচ্ছে জনমনে, হয়ে উঠছে আলোচনার বিষয়বস্তু। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ঘটে যাওয়া ঠিক তেমনি একটি ঘটনা ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।

২০১৮ সালের ১৯ মে ছিল ৩য় রমজান। চুয়েটের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে সিদ্ধান্ত নেন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের অনুজদের নিয়ে ইফতার করবেন একসাথে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শহীদ মোহাম্মদ শাহ হলের বর্ধিতাংশের পার্শ্ববর্তী মসজিদে ইফতার মাহফিল আয়োজিত হয়।

ইফতার শেষে রাতে তারাবীহর নামাজ পড়াকালীন সময়ে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবু নাঈমকে ফোন করে রুমে আসার নির্দেশ দেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা পুরকৌশল বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অতনু মুখার্জি।

জানা যায়, সে রাতে উক্ত ইফতার মাহফিলটি শিবিরের নেতাকর্মীদের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে উল্লেখ করে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জড়ো করে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে চুয়েট ছাত্রলীগ। আবু নাঈমের ভাষ্যমতে নাঈমকে এরপর বঙ্গবন্ধু হলের A ব্লকের ৪ তলায় অতনু মুখার্জির রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে নাঈম দেখতে পান আগে থেকেই উপস্থিত দুইজনকে স্ট্যাম্প হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাই নাঈমকে একই হলে C ব্লকের অন্য একটি কক্ষে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন আরেক ছাত্রলীগ নেতা পুরকৌশল বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাফসান জানি রিসান।

নাঈম আরো জানান, জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাদেরকে বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্টের রুমে নিয়ে গেলে সেখানে উপস্থিত তৎকালীন প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. কাজী দেলোয়ার হোসাইন ও তৎকালীন ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মশিউল হক তাদেরকে দ্রুত ক্যাম্পাস ত্যাগ করার উপদেশ দেন। একই সাথে তারা আরো জানান, চুয়েটের গেটগুলোতে ছাত্রলীগ পাহারা দিচ্ছে, বিকল্প পথে যেতে হবে।

কিন্তু ক্যাম্পাস ত্যাগের পূর্বেই চুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নিলয় দে সহ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নাঈমকে পাকরাও করে চুয়েটের ছাত্রসংসদের রুমে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে নাঈম চুয়েট ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ ইমাম বাকের ও সাধারণ সম্পাদক ও সাখাওয়াত হোসেন সম্রাটকে দেখতে পান। সেখান থেকে নাঈমকে একটি রুমে নিয়ে গিয়ে স্টাম্প দিয়ে বেধরক মারধর করার অভিযোগ উঠে। যার ফলে তার কবজি পর্যন্ত বাঁকা হয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়। এতেই ক্ষান্ত না হয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হাবিব ও কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নিলয় দে লোহার রড দিয়ে আবারো নাঈমকে মারধর করে। এভাবে চলে তার উপর সারা রাতব্যপী নির্যাতন।

সে রাতের ভয়াবহতা উল্লেখ করে আবু নাঈম চুয়েটনিউজ২৪ কে বলেন, এই রাত আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় রাত। শুধুমাত্র ইফতার করা ও নামাজ পড়ার কারণে আমি সহ প্রায় ৬০-৭০ জন সাধারণ ছাত্রদের উপরে শিবির সন্দেহে সে রাতে নির্মম নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগ নামক হায়নার দল। আমাকে প্রায় ৮ ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমি চাইনা বাংলাদেশের কোনো ক্যাম্পাসে এরকম রাতের পুনরাবৃত্তি হোক। আমি চাই গঠনমূলক রাজনীতি কিংবা ছাত্রসংসদ দ্বারা একটি জবাবদিহিতা মূলক পরিবেশ থাকুক। ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো নামেই যেন ছাত্রদের উপর অন্যায় ও জুলুম নেমে না আসে।

১৯ মে রাতে শুধু নাঈম নয়, চুয়েটের অগণিত ছাত্রদেরকে শিবির সন্দেহে তল্লাশি করা হয়। অনেককে হেনস্তা করা হয়। ইফতার মাহফিলে উপস্থিত ছাত্রদের চিহ্নিত করে জিজ্ঞাসাবাদ, মারধর করা হয়। এসময় অনেক শিক্ষার্থী গাঁ ঢাকা দেন। আবার অনেকেই ছাত্রলীগের আতঙ্কে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। কিন্তু যাদেরকে পাওয়া যায়, তাদের উপরই অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।

ছাত্রলীগের নির্মমতার আরেকজন ভুক্তভোগী কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাহির তালহা। তার ওপরেও সেই রাতে চালানো হয়েছিল পৈশাচিক নির্যাতন। তিনি সেই কালরাত্রির ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ঐ রাতে আমাদের মারতে মারতে যখন একের পর এক স্ট্যাম্প ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তখন ছাত্রলীগের ভাইয়েরা নতুন একটি নির্যাতনের পদ্ধতি আবিস্কার করলেন। খেলার মাঠে পিচের উপড় যেমন স্ট্যাম্প গাড়া হয় তেমনি আমাদের পায়ের উপর স্ট্যাম্প রেখে উপর থেকে বাড়ি দিয়ে স্ট্যাম্প গাড়তে শুরু করলেন।

তালহা আরো বলেন, আমি আমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে কোনো দিন চুয়েটের গোল চত্বর মাড়াই নি। এক ও দুই নং ক্যান্টিনে খেতে যাওয়ার সাহস করি নি। লুকোচুরির মধ্য দিয়ে আমার চুয়েটের বাকি দিনগুলো পার করেছি। আমার স্বপ্নের চুয়েট লাইফকে বিভীষিকাময় করার পিছনে জড়িত সবাই ছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। প্রাণের ক্যাম্পাসে আমার মতো আর কোনো স্বপ্নবাজ তরুণের স্বপ্ন গুলো যেনো হায়েনাদের ভয়াল থাবায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে না যায়।

সেই ঘটনায় চুয়েটের ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মশিউল হকের ভূমিকা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ক্যাম্পাসের এমন একটা অবস্থা ছিল, আমাদের ছাত্রদেরকে রক্ষা করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আর উপরমহলের চাপে আমাদের কি ই বা করার ছিল। আমরা শেষ পর্যন্ত চুয়েট ব্ল্যাকআউট করে ওদেরকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যারা এই অপরাধের সাথে জড়িত ছিল ওদের বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নিতে পারিনি। কারণ আমাদের হাত বাধা ছিল। আমরা কোনোদিন প্রকাশ করতে পারি নি যে ওদেরকে আমরা ক্যাম্পাস ছাড়তে সাহায্য করেছিলাম। আমাদের শিক্ষকদের অবস্থা এরকম ছিল।

শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, ১৯ মে রাতে চুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জামিল আহসানকে চুয়েট শিবিরের সভাপতি হিসেবে চিহ্নিত করে অনেকবার খুঁজে বের করার চেষ্টা কর হয়। কিন্তু জামিল আত্মগোপন করে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে সফল হন। জামিলের অভিযোগ, পরবর্তীতে তাকে হুমকি ধামকি দিয়ে ৫ লক্ষ টাকা দাবি করেন চুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি বাকের ও সম্পাদক সম্রাট। এক পর্যায়ে টাকা দিতে অসম্মতি জানানোয় ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই পরীক্ষা দেওয়ার পর জামিলকে আটক করেন তারা। তার উপর রাতভর চলে অমানুষিক নির্যাতন। স্টাম্প, রড, হাতুড়ি ইত্যাদি দিয়ে তাকে মারধর করা হয়। বিভিন্ন জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। শেষমেশ ছাত্রলীগ সভাপতি বাকের বাদী হয়ে একটি মামলা দিয়ে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গ্রেফতার হন জামিল। প্রায় ৩ মাস ১০ দিন জেল খাটার পর মুক্তি পান তিনি।

উক্ত ঘটনায় জামিল আহসান তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, আমাকে ছাত্রলীগ সভাপতি বাকের হুমকি দিয়েছিল টাকা চাওয়ার কথা বাইরে কাউকে বললে আমাকে শেষ করে দিবে। আমাকে অমানুষের মতো মারধর করে ছাত্রলীগ। যখন আমাকে মিথ্যে বানোয়াট মামলায় ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন প্রশাসন আমার পক্ষে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেনি।

জামিল আরো বলেন, আমি চাই, আমার সাথে যা হয়েছে তা আর কারো সাথে না হোক। চুয়েটের সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হোক। প্রতিটি শিক্ষার্থী নিরাপদে থাকুক।

চুয়েটের ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের তৎকালীন উপ-পরিচালক অধ্যাপক ড. জি.এম. সাদিকুল ইসলাম বলেন, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমার স্পষ্ট মনে আছে যখন শুনতে পারি যে ছাত্রলীগের ছেলেরা একজন ছাত্রকে (জামিল) আটকে রেখেছে মারধর করছে তখন ছুটে যাই। ছাত্রলীগের সভাপতি বাকেরের সাথে আমার অনেক্ষণ তর্ক বিতর্ক হয়। কিন্তু সে তাকে ছাড়তে রাজী না হলে আমি আধাঘন্টার আল্টিমেটাম দিই। এর মধ্যেই পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি চাইলে আমি বলি এখানে আমি অনুমতি দেওয়ার কেউ নই। ওরা জানায়, ওদের কাছে ভিসি স্যারের সম্মতি আছে। তারা দুইগাড়ি মানুষ নিয়ে ক্যাম্পাসে আসে একজনকে গ্রেফতার করতে। ওরা আমার লিখিত স্বীকারোক্তি চায় যে, আমরা (প্রশাসন) জামিলের কাছে অস্ত্র ও জিহাদী বই পেয়েছি। আমি বলি, চুয়েটের কোনো ছাত্র পরীক্ষার হলে এসব নিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। জামিলের কাছে আমরা এসব কিছুই পাই নি। তখন আমাকে বিভিন্ন ভাবে চাপ দেওয়া হয় ও ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়। আমি শেষমেশ বলি, আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারব না। প্রয়োজনে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান। তারা আমার সাথে পেরে ওঠে না এবং সেখান থেকে গিয়ে জামিলকে তুলে নিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। সেদিন রাতে আমি একা হয়ে পড়েছিলাম। ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক ছুটিতে ছিলেন। ভিসি স্যার ঘটনার মধ্যেই গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে চলে গিয়েছিলেন। উক্ত ঘটনার পরবর্তীতে আমি ছাত্রকল্যাণ দপ্তর থেকে আমাকে সরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানাই। লআমি সেদিনের কথা আজো ভাবি যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেকে আমরা রক্ষা করতে পারি নি।

চুয়েটের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল আলমের কাছে এসব ঘটনা নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, এসব তো আমার মাথায় নেই। অনেক আগের ঘটনা। এ ব্যাপারে কথা বলতে হলে আগের নথিপত্র দেখতে হবে। এ ছাড়া কথা বলতে পারব না।

চুয়েট ছাত্রলীগের উপর আনিত এসব অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে তৎকালীন চুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ ইমাম বাকেরের সাথে একাধিকবার মুঠোফনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায় নি।

উল্লেখ্য উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত অনেকের নাম এখন সামনে আনছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। আরো অনেকেই নিজের সাথে হওয়া অত্যাচারের ঘটনা বর্ণনা করছে। এতো বড় একটা ঘটনা সময়ের পরিক্রমায় চাপা পড়ে যাওয়ায় বিক্ষুব্ধ চুয়েটের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। এমন ন্যাক্কারজনক কাজের সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার দাবী জানান চুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *