নয় মাসেও বিচার হয়নি ছাত্রহলে মদ পানে অভিযুক্ত চুয়েট শিক্ষক রুম্মানের

চুয়েটনিউজ২৪ ডেস্কঃ

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একটি ছাত্র হলে গভীর রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক শিক্ষকের মদ পান ও এ নিয়ে তাঁর স্ত্রীর চেঁচামেচির ঘটনার নয় মাসেও সে শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গত বছরের ৩১ মে (শুক্রবার) চুয়েটের ৪৯ তম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত কনসার্টের একপর্যায়ে দিবাগত রাত চারটায় শহীদ তারেক হুদা হলে কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে মদ পানরত অবস্থায় ছিলেন পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক শাফকাত আর রুম্মান। এর কিছুক্ষণ পর তাঁর স্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক কাজী জান্নাতুল ফেরদৌস ঘটনা স্থলে পৌঁছান। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে মদ পানরত অবস্থায় স্বামীকে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ও উপস্থিত সবাইকে বকাঝকা, এমনকি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করেন। একপর্যায়ে তিনি হলের নিচে নেমে রাস্তায় আহাজারি করতে থাকেন। পরে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা জান্নাতুলকে শান্ত করেন ও ওই শিক্ষককে ধরাধরি করে শিক্ষক ডরমিটরিতে পৌঁছে দেন।

বিষয়টি জানাজানি হলে শহীদ তারেক হুদা হলের তখনকার প্রাধ্যক্ষ নিপু কুমার দাসের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ৪ জুন দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চুয়েটের গণিত বিভাগের অধ্যাপক সুনীল ধরকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে নির্ধারিত সময় পার হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন মাস পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর প্রায় ৬ মাস সময় পার হলেও কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এদিকে ছাত্রজনতার আন্দোলনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ২৩ দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। ২৩ দফার তিন নং দাবি ছিল অভিযুক্ত শিক্ষক শাফকাত আর রুম্মানের শাস্তি নিশ্চিত করা। অভিযুক্ত এ শিক্ষকের বিচারের জন্য বারবার দাবি জানিয়ে আসার পরেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন উপায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সম্প্রতি ৬ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) অভিযুক্ত এ শিক্ষকের শাস্তি ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বহিষ্কারের দাবিতে প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে ছাত্রলীগের ১৮ নেতাকর্মীকে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার ও অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উপাচার্য আশ্বাস প্রদান করলে বিক্ষোভ প্রত্যাহার করেন তাঁরা।

পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকরা আমাদের রোল মডেল। তাদের থেকে আমরা শিক্ষা নেই। অথচ পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক শাফকাত আর রুম্মান হলে ছাত্রদের সাথে বসে মাদক গ্রহণ করার মতো গর্হিত কাজের প্রায় নয় মাস হলেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। পাশাপশি তার স্ত্রী ইলেকট্রনিকস এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক কাজী জান্নাতুল ফেরদৌস গভীর রাতে ছাত্রহলে প্রবেশ করে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের বেধরক মারধর করেন, যা সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ হওয়ার কথা।কিন্তু এই ঘটনার স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণাদি, সিসিটিভি ফুটেজ থাকা স্বত্তেও শুধুমাত্র শিক্ষক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা না নেয়া খুবই লজ্জাজনক ও আমাদের জন্য হতাশাজনক।

আমিনুল আরো বলেন, ঘটনার এত দিন পরেও অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়া চুয়েট প্রশাসনের মাদকবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতি এবং প্রশাসনের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মাদকের সাথে জড়িত ব্যক্তি যেই হোক, আমরা তার সঠিক বিচার চাই এবং মাদকমুক্ত চুয়েট ক্যাম্পাস চাই।

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের তৃতীত বর্ষের শিক্ষার্থী আদিল রায়হান বলেন, মাদক বন্ধের উদ্দেশ্যে বর্তমানে চুয়েট প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপগুলো নি:সন্দেহে সাধুবাদ প্রাপ্য। কিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক যে, শিক্ষার্থীদের বেলায় প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকলে মদপানে অভিযুক্ত এ শিক্ষকের বেলায় প্রশাসন চুপ আছে এখনো। ছাত্রজীবনে উনি ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাচমেট, ক্যান্টিন বয়দের গাঁয়ে হাত তোলা ও মাদক গ্রহণের ইতিহাস বিদ্যমান থাকার পরেও তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও তিনি এমন ন্যাক্কারজনক কাজগুলো চালিয়ে গিয়েছেন। প্রকাশ্যে হলে বসে ছাত্রদের সাথে মাদক গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর স্ত্রী গভীর রাতে ছাত্রহলে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের মারধর করেছেন। এসব কিছুর প্রমাণ প্রশাসনের কাছে আছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা সহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা করা হলেও এখন পর্যন্ত উনার বিরুদ্ধে প্রশাসন এর পক্ষ হতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বারবার উনার বিরুদ্ধে যথাযথ ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি আসার পরেও, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ হতে দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া শিক্ষার পরিবেশের জন্য নিদারুণ ক্ষতিকর।  গত ৬ ফেব্রুয়ারি আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের পদধারী নেতাকর্মী ও তাঁর শাস্তির দাবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে অবস্থান নেই। পরে উপাচার্য স্যারের বিচারের আশ্বাসে আমরা বিক্ষোভ প্রত্যাহার করি। তাই আমরা চাই, প্রশাসন যেন মাদক নির্মূলের পাশাপাশি মাদককে প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ঘোষণার সাথে সাথে উনার বিরুদ্ধে অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেয় এবং পরবর্তীতে যেন কেউ এমন কার্যক্রমে যুক্ত না হতে পারে, সে ব্যবস্থা করে।

শিক্ষকের এমন কর্মকান্ডে বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন প্রাক্তনরাও। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শাকিল আহমাদ ইকবাল বলেন, শাফকাত আর রুম্মান বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল। এমনকি এসব অভিযোগের কিছু ভিডিও প্রমাণ আমরা দেখেছি। তাঁর এসব কর্মকান্ডের প্রতিবাদে যারা সরব ছিল, তাদেরকে সে নানাভাবে হুমকি দিয়েছে। এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে শিক্ষক হিসেবে বহাল রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। একজন শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা শুধু মাত্র শিখে না বরং সে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। ছাত্রদের হলে এসে শিক্ষার্থীদের সাথে মদ পান, কনসার্টের মধ্যে তাদের সাথে গাজা সেবন, এসবের প্রতিবাদে তাঁর শাস্তি দাবী করাতে ফেসবুকে হুমকি দেওয়া এতোসব অভিযোগ ও এর প্রমাণ থাকার পরেও শাফকাত আর রুম্মান কে শিক্ষক হিসেবে চুয়েটে বহাল রাখা এটা শিক্ষক জাতির জন্য অসম্মানের। একই সাথে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের জন্য হুমকির। প্রশাসন গতকাল মাদক সেবনের অভিযোগে চার শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে। প্রশাসনের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে আমরা চাই এটি শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, অভিযুক্ত শিক্ষকের বেলায়ও এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিচারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ শিক্ষার্থীসহ আমরা প্রাক্তনদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।

এ বিষয়ে পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শিক্ষকেরা হচ্ছেন অনুকরণীয়। শিক্ষকরা  ছাত্রদের শেখাবে, বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করবে। কিন্তু কোন শিক্ষক যদি এরকম গর্হিত কাজ করে, এটি খুবই উদ্বেগজনক। এগুলো কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। এরকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে কালক্ষেপন করা অনুচিত। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হলে কমিটিতে কারা রয়েছেন সেটি প্রকাশ করতে হবে যাতে যে কেউ কমিটিকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান সাপেক্ষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়া তিনি আরো বলেন, এমন অপরাধের বিচার না হলে অন্যদের কাছে খারাপ বার্তা পৌছাবে। তখন অন্যরাও বিভিন্ন অনিয়ম, অপরাধে ঝুঁকে পড়বে৷ তাই এ বিষয়ে কালক্ষেপণ না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ আব্দুল মতিন ভূইয়া বলেন, পূর্ববর্তী তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সিন্ডিকেটের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় সিন্ডিকেট অধিকতর তদন্তের জন্য সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে আরেকটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছেন। সে কমিটির কাজ চলমান রয়েছেন। তাদের প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষক শাফকাত আর রুম্মান চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং চুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। শিক্ষার্থী থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে সহপাঠীকে মারধর, শহীদ মোহাম্মদ শাহ হল ক্যান্টিনের কর্মচারীকে মারধর, মাদক গ্রহণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *