সাদিক লতিফ:
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় ২৮ আগস্ট, ১৯৬২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, চট্টগ্রাম নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্যাকাল্টি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর অধীনে ১২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আজকের চুয়েটের তৎকালীন কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সরকারী অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৬ সালের ১লা জুলাই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে চারটি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি) স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তা ছিলো নামমাত্র।। প্রশাসনিক নিরাপত্তা, উন্নয়ন বাজেটসহ নানা খাতে জটিলতা লেগেই ছিলো। তাছাড়া, তৎকালীন সময়ে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ‘বিএসসি ফ্রম এনি ভার্সিটি’ উল্লেখ থাকায় ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে স্বায়ত্বশাসনের দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়।। একটি কাঠামোবদ্ধ যুগপৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ১লা সেপ্টেম্বর ২০০৩, চুয়েট আত্মপ্রকাশ করে। ফলশ্রুতিতে নিজস্ব সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, আর্থিক ব্যবস্থাপনা কমিটি, একাডেমিক ও অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা কমিটি গঠিত হয়। নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। যার সুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক, তিন সরকার ধরে চলা এ আন্দোলনে জলঘোলা কম হয় নি। কখনও জিয়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ZUET) , কখনও রাউজানের ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে হল প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা শক্ত হাতে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ দমন করেছে। শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞতার সাথে আন্দোলনের পথিকৃৎ আজিজ মিশির সেলিম ভাই, সাকি কাউসার স্যার সহ সকল সাবেক শিক্ষার্থীকে স্মরণ করছি।

আবু সাদাত মোঃ সায়েম স্যার বি আই টি থাকাকালীন সর্বশেষ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শিক্ষক-সমিতির সাবেক সভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের সময় স্যারের মহামান্য শিক্ষকেরা তাঁদেরকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। মাত্র দুই মাসের মাথায় স্যার ও তাঁর সকল ব্যাচমেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে বের হয়েছিলেন (সূত্র -২১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্যারের প্রদত্ত ভাষণ হতে )। অর্থাৎ জন্মলগ্ন থেকেই চুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মধুর। আমরা দেখেছি, আমাদের শিক্ষকরা খুবই বন্ধুভাবাপন্ন, আমাদের যেকোন সমস্যা সমাধানে তারা সর্বদা উদ্যোগী থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ল্যাবের সহকারী মহোদয়গণও অত্যন্ত দক্ষ, কোন শিক্ষককেই আলাদা করে অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা লাগে না ।। আগের তুলনায় ঢাকা হতে চট্টগ্রামে যাতায়াতে ৩ ঘন্টা সময় হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবী ৩ ঘণ্টা এগিয়েছে। দ্রুত এগিয়ে চলা এ পৃথিবীতে ইউটিউব, চ্যাট জিপিটি রান করলে কাঙ্ক্ষিত উত্তরের বিস্তারিত পাওয়া যায়। আমাদের শিক্ষকেরাও এরকম পরিবেশে নিজেদের অভ্যস্ত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করেছেন।
‘আইডিয়া(স) কানেক্ট দ্যা ওয়ার্ল্ড’ – চুয়েটের পরিবেশ মুক্ত বুদ্ধি চর্চার জন্য উন্মুক্ত, ব্যবসায়িক থেকে সাংগঠনিক বুদ্ধিচর্চ্চা সর্বদা-ই উৎসাহিত করা হয়। তবে ইনোভেটিভ আইডিয়াগুলোর প্রয়োগক্ষেত্র কম ৷ ইনকিউবেটর পুরোদমে চালু হলে আশা করা যায় এর সমাধান হবে।
আমরা একটি উচ্চমাত্রার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভর্তিপরিক্ষা দিয়ে চুয়েটে প্রবেশ করেছি। চুয়েটের ওয়েবসাইটে মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের বার্তায় উল্লেখ আছে, চুয়েটের লক্ষ্য হলো – ‘প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানবসম্পদের মান উন্নয়ন করা’। যুগের সাথে তাল মেলাতে চুয়েট আমাদের ‘আউটকাম বেজড এডুকেশন (ওবিই কারিকুলাম)‘র দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন আমরা আমাদের কার্যক্রমে দেখতে পাচ্ছি। অচিরেই এর সুফল আমরা পাবো আশা করা যায় ।

এছাড়াও, চুয়েটে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রশাসনের সকল স্তরে সুশাসন ও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রচার করার মিশন লালন করে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পায়, আমাদের প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় কতিপয় সমস্যার দরুন নেতিবাচক শিরোনামের অংশ হয়েছে, কর্তৃপক্ষ সমস্যাগুলো শুধু শক্ত হাতে দমন-ই করেননি সচেতনতার ব্যবস্থাও করেছেন । উপরন্তু চুয়েটের প্রত্যেকটি জায়গায় যেভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা মেনে চলা হয়; আমরা তার সুফলভোগী সাক্ষী। এছাড়াও স্টাফ এসোসিয়েশন, চুয়েট বাংলাদেশের অন্যতম স্বীকৃত শক্তিশালী সংগঠন। কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতি নিয়মিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন করে। তবে, ছাত্রনেতৃত্ব তৈরিতে কর্তৃপক্ষের আরো যত্নবান হওয়া জরুরী ।
১৭১ একরের উপত্যকা ঘেরা এই ক্যাম্পাস প্রতিটা মৌসুমে রূপ বদলায়, ‘সবুজ স্বর্গ’ খ্যাত চুয়েটে আপেক্ষিকভাবে সময় ধরে পাওয়া যায় , এ কথা সবাই স্বীকার করে । চুয়েটে বিভিন্নরকম উন্নয়ন কাজ চলমান ও দৃশ্যমান। তবুও শিক্ষার্থীদের কিছু জায়গায় সমস্যার সমাধান কর্তৃপক্ষ একটু সচেষ্ট হলেই করা সম্ভব। আমাদের এই লেখার উদ্দেশ্য সেদিকেই ধাবিত হওয়া ।
২১শে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদীর সাংবাদিক এম. এ মালেক বলেছেন, “চট্টগ্রামের প্ল্যানিং, বিপদাপদ, সমস্যা-সমাধানে চুয়েটের অবদান অস্বীকার্য। কিন্তু চুয়েট কর্তৃপক্ষ বানিজ্যিক নগরীর পুরোপুরি সুবিধা গ্রহন করতে পারে নি। এর পিছনে অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি।
চুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রবৃন্দ প্রায় সবাই ই অনেক ভালো অবস্থানে আছেন। কিন্তু অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনকে শক্তিশালী করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েনি। ক্যাম্পাসে আসার পর অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনভিত্তিক কোনো প্রোগ্রামও হতে দেখি নি। ক্লাসরুমের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তাছাড়া , ছাত্রদের ক্লাসরুমের নিমিত্তে নির্মাণাধীন বিভিন্ন প্রকল্পেও রয়েছে অস্বাভাবিকরকম স্থবিরতা । বিদেশী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা একেবারেই শূন্য। এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপও নেই ।
পিএইচডি ও মাস্টার্স ফিল্ডে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকার ‘উচ্চ শিক্ষার জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা’গ্রহন করেছে যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির ৮% উচ্চশিক্ষাখাতে ব্যয় করা হবে(এটা বর্তমানে ০. ৯৫%)। অতএব বোঝাই যাচ্ছে , এটি একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্র। সরকারের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে ফান্ডিং এর জন্য ইন্ডাস্ট্রি গুলোর সাথে কোলাবোরেশন বাড়াতে হবে ।
শুনা যায়, ইঞ্জিনিয়ার যারা উদ্যোক্তা হয় তাদের সফলতার হার তুলনামূলক বেশী। বর্তমান সরকার সারাদেশে কোয়ালিটি এডুকেশন প্রোভাইড করার জন্য নানারকম উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেছে। ক্যাম্পাসভিত্তিক সর্বপ্রথম আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর চুয়েটে-ই রয়েছে, ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ জনবল বণ্টন বিষয়ক দাপ্তরিক জটিলতার কারণে এর কার্যক্রমে শিথীলতা আসা নিতান্ত-ই দুঃখজনক । আগামী দিনে ক্যাম্পাস হতে জনবল দ্বারা এর অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশা রাখি। চুয়েট হতেই শুরু হবে বড় বড় স্টার্ট- আপ ।
চুয়েট বিভিন্ন সময় দেশের মধ্যে অনেক গৌরবজনক কাজের পথিকৃৎ হওয়ার সাহস দেখিয়েছে। আয়োজন করেছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে প্রথম সফলতম “রিসার্চ ফেয়ার”। গতবছর(২০২৩) প্রকাশিত সিমাগো র্যাঙ্কিংয়ে চুয়েটের গণিত বিভাগ, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, পুরকৌশল সহ বেশ কটি বিভাগ দেশ ও বিশ্বসেরা হয়েছে। কিউএস র্যাঙ্কিংয়েও দেশের ২য় সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এখন চুয়েট। আমাদের পিএমই(পেট্রোলিয়াম এন্ড মাইনিং) ডিপার্টমেন্টও সারাবিশ্বের জ্বালানি সম্পর্কিত ১৫০টি বিভাগের মধ্যে র্যাঙ্ক করেছে । অর্থাৎ আমাদের সাফল্যের মুকুটে ক্রমান্বয়ে আরও পালক যুক্ত হচ্ছে । যাই হোক, প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে চুয়েটের নাম হওয়ার কথা ছিলো চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো এক বৃহৎ অপশক্তির কারণে তার সম্ভব হয়নি। তারা আজও নানাভাবে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করছে। তাঁদের সাথে গবেষণাবাৎসল এ চুয়েট সুস্থ ধারার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আগামী দিনে ১ নম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠবে এটাই কামনা করি ইনশাল্লাহ। প্রত্যেক জন্মদিনেই আমাদের মানুষকে উপহার দেওয়ার প্রচলন আছে। ঠিক তেমনি আমরা আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাসের পরবর্তী জন্মদিনের জন্য নিজ নিজ আসন থেকে কতটুকু উপহার তৈরী করছি তা ভাবা প্রয়োজন ।
পরিশেষে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জামাল উদ্দিন আহমেদ স্যারের ভাষায় বলতে চাই, “হে আমার চুয়েট, তুমি আমার আবেগ, আমার প্রেরণা/ তোমাকে নিয়ে কেউ কথা বলতে পারে না?/ আমরা যদি ঠিক থাকি (ইনশাল্লাহ) কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবেনা।“ একুশ বছরের টগবগে চুয়েট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত ২০৪১ সালের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে দক্ষ, যোগ্য প্রকৌশলী গঠন করবে ইনশাল্লাহ, এবং সেই সকল দক্ষ ও যোগ্য প্রকৌশলীরা আগামী দিনে নেতৃত্বের আসন অলঙ্কৃত করবে এই আশা ব্যক্ত করে শেষ করছি।
লেখকঃ সাদিক লতিফ, শিক্ষার্থী, পেট্রোলিয়াম এন্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।