বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীতা; চুয়েট শিক্ষার্থীদের অভিমত

ফাইয়াজ মুহাম্মদ কৌশিকঃ

“বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই”। মন খারাপ তো সবারই হয়। তবে সেই মন খারাপ যদি রুপ নেয় মানসিক অসুস্থতায়, তবে তার পরিণতি কখনই ভালো হয়না।

এইত গত বছরের কথা, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(রুয়েট) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সর্বমোট তিনজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা হওয়ার খবর শোনা যায় অল্প কিছুদিনের ব্যবধানেই। এছাড়া আরও একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সারা দেশে ৯৮ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৪২ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এমনকি এ বছর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করার খবরও শোনা গেছে।

অধিকাংশ আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা কিংবা শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়মিত না হতে পারা সহ নানা কারণে বিষণ্নতায় ভোগা।

এছাড়া এমন অসংখ্য শিক্ষার্থী আছেন তারা হয়ত আত্মহত্যা করেন নি, কিন্তু বিষন্নতা তাদের ঠেলে দিয়েছে মাদকের ভয়াল থাবায়। অথচ এরাই জীবনের নানা সংগ্রাম শেষে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসেছিলেন। তাহলে অমিত সম্ভাবনার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কেন এ বিপর্যয়!

কিছুদিন আগে চুয়েটের বিভিন্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মাদক বিরোধী ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে। যেখানে মাদক কান্ডে জড়িতদের শাস্তির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলো তুলে ধরা হয়। তবে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই মনে করেন এসব মাদকগ্রহণকারীদের শাস্তির পাশাপাশি এর প্রতিরোধের জন্যও ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। প্রবাদই তো আছে- “প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।”

শিক্ষার্থীদের মনে হতাশা ও এর পেছনের কারণ সমূহ চিহ্নিত করেছেন অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল হাসনাত পিয়াস। তিনি বলেন,একজন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদেরকে প্রত্যেকদিন ক্লাস, ল্যাব ও পরীক্ষা এর সম্মুখীন হতে হয় তারপর ক্লাস শেষে ল্যাব করা লাগে। ল্যাব শেষে অনেকেই নিজেদের খরচের বোঝা টানতে টিউশন করাতে চলে যায়। তারপর টিউশন শেষে হলে ফিরে পরের দিনের পড়া গোছাতে হয় ও ল্যাব রিপোর্ট লিখতে হয় । সব মিলিয়ে আমাদের সারাদিন পড়াশোনা সহ বিভিন্ন কাজে শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদের বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, প্রধান সমস্যা হচ্ছে পারিবারিক চিন্তা, চাকরি নিয়ে চিন্তা, রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা, অনেক সময় রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় স্যারদের বকাঝকার শিকার হতে হয়। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

মানসিক সুস্থতা ও বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ব্যাপারে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন রায়হান বলেন,

বর্তমানে প্রায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নাজুক। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার উন্নতি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে. যেমন শিক্ষার্থীদের আর্থিক স্বচ্ছলতা প্রদানের জন্য ইন ক্যাম্পাস জব এর ব্যবস্থা। এতে করে তাদের মূল্যবান সময় বেঁচে যাবে যা তারা শহরের টিউশনিতে ব্যয় করতো। ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র নিয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য অ্যালামনাইদেরকে নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে। নিজ নিজ ডিপার্টমেন্টে যদি এমন পরিবেশ তৈরি করা যায় যেখানে ছাত্ররা বিনাদ্বিধায় নিজেদের কথা শিক্ষকদের সাথে শেয়ার করতে পারে তাহলে ছাত্রদের মানসিক উন্নতি অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও হল গুলোতে খাবারের মান বৃদ্ধি এবং খেলাধুলা ও অন্যান্য এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটি নিয়মিত বজায় রাখতে পারলে ছাত্রদের নাজুক মানসিক অবস্থার অনেকটাই উন্নতি করবে বলে আমি মনে করি।

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরামর্শ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইতমাম উবায়েদ সামিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নবীনদের অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে যেমন: ভালো রেজাল্ট, রিসার্চ, নতুন পরিবেশে নতুন মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক ইত্যাদি৷ কিন্তু পরবর্তীতে একটা বিশাল অংশ আসলে এসব লক্ষ্য অর্জনে ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হয়। এর কিছু কারণের মধ্যে প্রথম হলো পরিবার থেকে দূরে এসে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পারা,ম্যানার শেখানোর নামে সিনিয়রদের দ্বারা বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া। এসব পরিস্থিতির স্টীমরোলারে নিষ্পেষিত হয়ে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা’র অপমৃত্যু ঘটে। হতাশার বেড়াজাল তাকে ঠেলে দেয় মাদকের ফাঁদে।
এহেন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ও সার্বিক পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো, সঙ্গ নির্বাচন এসব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং তাকে হতাশার বেড়াজাল থেকে অনেকখানি পরিত্রাণ দিবে।

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বন্ধুরা রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব নাবিল বলেন,

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভালো বন্ধুরা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। ভার্সিটি লাইফের এই কঠিন সময়ে বন্ধুরাই একে অপরের মনোবল জোগায় এবং একে অপরের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে

কোন বিষয় নিয়ে হতাশা বা কোন ধরনের সমস্যায় পড়লে বন্ধুদের সাথে খোলামেলা ভাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যায়। যা তার মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং সেই সমস্যা সমাধানেরও একটি ব্যবস্থা হয়। এছাড়াও বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা বা আড্ডা দেয়ার মাধ্যমে মনকে হতাশা ভুলিয়ে অন্য দিকে মনোনিবেশ করানো যায়।

তবে মাঝেমাঝে অনেক সময় হিতে বিপরীতও হতে দেখা যায়। কারও মানসিক অবস্থা ভালো না, কোনো কারণে ডিপ্রেসড বা হতাশ এটা জানার পর অনেক বন্ধুরা আবার বিষয়টি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে থাকে। যা তার মানসিক অবস্থাকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যায়। তাই বন্ধু হিসেবে সবার উচিত পাশে দাঁড়ানো। পরিবার থেকে দূরে থাকাবস্থায় বন্ধুরাই পারে বিপদে আপদে পাশে এগিয়ে আসতে।

সর্বোপরি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুরাইয়া পারভীন প্রান্তিকা। তিনি জানান,
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। তবে একাডেমিক চাপ, ব্যক্তিগত সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে পারে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে একজন শিক্ষার্থী শুধু পড়াশোনায় নয়, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনেও সফল হতে পারে।

যদি একটু বিশ্লেষণ করে বলি, মানসিক সুস্থতা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে এবং পড়াশোনায় উন্নতি করতে সহায়তা করে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে মানসিক সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া, মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থীরা সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে ও নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে।

সুতরাং, মানসিকভাবে সুস্থ থাকা একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *