চুয়েটনিউজ২৪
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ ১লা সেপ্টেম্বর। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে প্রকৌশল বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে ‘চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে এটি যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ টেকনলোজি (বিআইটি) তে রুপান্তর করা হয় এবং সর্বশেষ ২০০৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর দেশের প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ধারক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে নতুন পরিচয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। আজ গৌরবময় পথচলার ২২ তম বর্ষে পদার্পণ করল চুয়েট।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত চুয়েট ক্যাম্পাস
লিখেছেন: আসাদুল্লাহ গালিব

চুয়েটের ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্র
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার পাহাড়তলি ইউনিয়নের চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের পাশে প্রায় ১৭১ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত চুয়েট ক্যাম্পাস । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি এই চুয়েট। পাহাড় বেষ্টিত এই মনোরম ক্যাম্পাসে টিলা, সমতলভূমি এবং প্রাকৃতিক জলাশয়ের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে।
চুয়েট ক্যাম্পাস অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ। ঘন সবুজ গাছপালায় আবৃত পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ এর সৌন্দর্য সহজেই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এই ক্যাম্পাসে রয়েছে ছোট বড় লেক, নানা প্রজাতির ফুলের সমাবেশ। পদ্ম পুকুরে ফুটন্ত পদ্মফুলের বিচিত্র সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করে তোলে।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। একেক ঋতুতে এক এক সাজে সেজে ওঠে এই চুয়েট ক্যাম্পাস। বর্ষাকালে পিচঢালা ভেজা রাস্তার সৌন্দর্য বিমোহিত করে তোলে সকলকে, বাড়িয়ে তোলে লেকের সৌন্দর্য, মাঠে ফুটবল খেলায় মেতে উঠে শিক্ষার্থীরা।
শীতকালে ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় ক্যাম্পাস। গাছ গাছালির পাতা ঝরে যায়, শুকনো ঝরাপাতার শব্দ অন্যরকম এক অনুভূতি জাগায়। বসন্তে কোকিলের ডাক আর গাছে গাছে নতুন পাতা ও ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকালে যেন মনে হয় সবুজের বুকে শুধুই লালের রাজত্ব।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইমারতের সৌন্দর্য চুয়েটকে করে তুলেছে অনন্য। এখানে রয়েছে প্রকৌশলবিদ্যার অনুকরণে দৃষ্টিনন্দন সব অবকাঠামো ও স্থাপনা। আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের মত আইকনিক স্থাপনা রয়েছে, শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে রয়েছে শহীদ মিনার, স্বাধীনতা ভাস্কর্য, ঝুলন্ত সেতু প্রভৃতি।
এ তো গেল চুয়েটের অভ্যন্তরের সৌন্দর্যের বর্ণনা।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাদরে আবৃত এই চুয়েট ক্যাম্পাস। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসের পূর্ব দিকে রয়েছে রাবার বাগান, উত্তর দিকে ঘটেছে পাহাড় ও উপত্যকার সমাবেশ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী নদী বহমান এবং ৩০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মানবসৃষ্ট হ্রদ কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদের সঙ্গে পাহাড়ের অকৃত্রিম সহাবস্থান এককথায় অতুলনীয়।
পছন্দের তালিকায় শীর্ষে চুয়েট
লিখেছেন: ফাইয়াজ কৌশিক

চুয়েট থেকে কয়েক’শ কিলোমিটার দূরে বসবাস ময়মনসিংহের মোস্তফা খালিদ বিন শামস আরিয়ানের। স্কুলের বড়ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম চুয়েটের গল্প শোনা। তারপর থেকেই ‘সবুজ স্বর্গ’ খ্যাত চুয়েটের শিক্ষার্থী হয়ে উঠার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় যন্ত্রকৌশল বিভাগের ২১ ব্যাচের শিক্ষার্থী হওয়ার মাধ্যমে। আরিয়ানের মত অনেকেরই প্রতিবছর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে চুয়েট। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ২১ ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী আকিফা মনজুর তিশা। তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে ছিল তার প্রকৌশল পড়ার স্বপ্ন। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে বরাবরই আকর্ষন করে। সেই আকর্ষণ থেকেই সমন্বিত প্রকৌশল গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে চুয়েটে আসা। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন ও দূর্যোগ মোকাবিলা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে তার। চুয়েটের জন্য সাফল্য বয়ে আনতে চান তিনি।
এছাড়া, চট্টগ্রাম বিভাগ তো বটেই, সারা দেশের প্রায় সব জেলা থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন শত শত শিক্ষার্থী। তাদের আকর্ষণের মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয়টির সৌন্দর্য এবং পড়ালেখার পরিবেশ। প্রকৃতি কন্যা চুয়েটে প্রকৌশল-বিদ্যা গ্রহণের সু্যোগ হাত ছাড়া করবে কে? তাই তো দক্ষিণ বঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ, চুয়েট সর্বত্র জনপ্রিয়। পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে পর্যাপ্ত হল সুবিধা। আর স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য রোজ বেশ কয়েকটি বাস শহর থেকে চুয়েটে চলাচল করে। রোজ ভোরবেলায় ক্লাস করতে শহর থেকে ছুটে আসেন প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অসংখ্য শিক্ষার্থী।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে চুয়েট
লিখেছেন: সাইকা শুহাদা

চুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রকৌশল বিদ্যার চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও সক্রিয় থাকে। যখন প্রযুক্তির অন্তর্গত রহস্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে তখন চোখের সামনে খুলে যায় এক অন্য জগতের দরজা। ক্লাবগুলো এক একটি যেন মায়াজাল, যেখানে প্রকৌশলের পরিশ্রমের ক্লান্তি মুছে যায়। সামাজিক দায়িত্ব পালন ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্যদিয়ে তারা খুঁজে পায় আত্নার প্রশান্তি। চুয়েটের ১৭১ একরের ভূমিতে নিবন্ধনকৃত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা অন্তত ২০টি। সংগঠনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- চুয়েট সাংবাদিক সমিতি, চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি, চুয়েট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, চুয়েট চলচ্চিত্র সংসদ, ভাষা ও সাহিত্য সংসদ চুয়েট, রোবটিক চর্চা ও গবেষণামূলক সংগঠন- ‘রোবো মেকাট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশন’, মহাকাশ ও রোবটিক গবেষণা সংস্থা ‘অ্যান্ড্রোমেডা স্পেস অ্যান্ড রোবটিক্স রিসার্চ অরগ্যানাইজেশন’, চুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাব, চুয়েট কম্পিউটার ক্লাব , চুয়েট স্পোর্টস ক্লাব, চুয়েট চেস ক্লাব, বিশ্বের সর্ববৃহৎ পেশাজীবীদের সংগঠন- ‘ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রনিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স’, চুয়েট মডেল ইউনাইটেড ন্যাশনস ক্লাস, অ্যামেরিকান সোসাইটি অফ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার্স, সাপ্লাই চেইন এন্ড বিজনেস এলাইয়েনস, অ্যামেরিকান সোসাইটি অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স, দ্যা অ্যামেরিকান কনক্রিট ইনস্টিটিউট, সোসাইটি অফ পেট্রোলিয়াম
ইঞ্জিনিয়ার্স, চুয়েট কেড সোসাইটি, চুয়েট অটোমোটিভ এন্ড মোবিলিটি সোসাইটি,
পরিবেশ সচেতনতামূলক সংগঠন- ‘গ্রিন ফর পিস’, সাংস্কৃতিক সংগঠন- ‘জয়ধ্বনি’,
সামাজিক সংগঠন- ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ’। স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে বসুন্ধরা শুভসংঘ। বিশ্ববিদ্যালয়টির আশেপাশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদানের মহৎ উদ্দেশ্যে চুয়েট শিক্ষার্থীরা পরিচালনা করেন “প্রদীপ” স্কুল।
এরমধ্যে চুয়েট সাংবাদিক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ, সফলতা-ব্যর্থতা দর্পনের ন্যায় হুবহু জাতির সামনে তুলে ধরে। কোনো অসংগতি দেখা দিলে তার যৌক্তিক সমালোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এছাড়াও চুয়েটের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর মানুষের জন্য তহবিল ও ত্রাণ সংগ্রহ এবং বিতরণ করেছেন চুয়েট শিক্ষার্থীরা। দেশের এ ক্রান্তি লগ্নে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলুমনাই ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য উদ্ধারকাজে স্পিডবোট এর ব্যবস্থাসহ খাগড়াছড়ি, ফেনী, নোয়াখালী, ফটিকছড়ি, কুমিল্লা, সিলেটের মত বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকায় প্রায় হাজার খানেক পরিবারকে সহযোগিতা করে চুয়েট শিক্ষার্থীরা। চুয়েটের শিক্ষার্থীরা মানবতার শিল্পের নিপুণ কারিগর।