কেমন উপাচার্য চান চুয়েট শিক্ষার্থীরা?

আসহাব লাবিব:

প্রকৌশলী তৈরিতে বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে বিআইটি-চট্টগ্রাম ও ২০০৩ সালে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় প্রতিষ্ঠানটি।

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পথচলার ২১ বছরে পাঁচজন শিক্ষাবিদকে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছে চুয়েট। পঞ্চম উপাচার্য হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালের ১৫ ই এপ্রিল নিয়োগ পান চুয়েটেরই ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক, ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট আবারো ২য় মেয়াদে ভিসি হন তিনি।

ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ আগস্ট চুয়েট শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম।

রফিকুল ইসলামের পদত্যাগের পর থেকেই চুয়েটের নতুন উপাচার্য কেমন হওয়া চায় সেই নিয়ে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। অভিভাবক হিসেবে কেমন উপাচার্য চান তারা? সেই মতামত জানতে চুয়েটের ৬ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে চুয়েটনিউজ২৪। শিক্ষার্থীদের মতামতে উঠে এসেছে তাদের নানা চাওয়া পাওয়া ও নতুন সম্ভাবনার কথা।

চুয়েটের যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকদের মধ্য থেকেই উপাচার্য নিয়োগ চান মোহাব্বত

মাহফুজুর রহমান মোহাব্বত

পুরকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান মোহাব্বত। শুরু থেকেই চুয়েট সংস্কারের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি চান চুয়েটের যোগ্যতা সম্পন্ন সম্মানিত শিক্ষকদের মধ্য থেকেই উপাচার্য নিয়োগ করা হোক। তিনি বলেন, যোগ্যতা হিসেবে সৎ ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। ভিশনারি হতে হবে। ভালো নেতৃত্ব গুণ সম্পন্ন ও প্রশাসনিক দক্ষতার পাশাপাশি ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা,কর্মচারিদের মধ্যে ভালো সমন্বয়কারী হিসেবেও তিনি ভুমিকা রাখবেন। চুয়েটকে নতুন করে সাজাতে আমাদের দাবি আদায় ও ছাত্রলীগের দোষীদের বিচারে স্পষ্ট পদক্ষেপ নেবেন এবং নতুন চুয়েট গঠনে জোরালো ভুমিকা রাখবেন। সর্বোপরি আমি চাই অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে চুয়েটে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে।”

পেশাদার কাজে রাজনৈতিক মতাদর্শ উপেক্ষা করবেন এমন উপাচার্য চান অনুরাগ

অনুরাগ নন্দী

যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনুরাগ নন্দী, উপাচার্য নির্ধারণে বিভিন্ন বিষয়ের কথা উল্লেখ করে অনুরাগ বলেন, প্রথমেই সোজা সাপটা কথায় একজন প্রাতিষ্ঠানিক নেতা হিসেবে পেশাদার কাজে তিনি কোনো এক পক্ষকে সমর্থন করতে পারবেন না। উনার মধ্যে পেশাদার খাত গুলোতে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শীদের বেশি সুযোগ দেওয়ার প্রবণতা থাকতে পারবে না। এমন প্রাতিষ্ঠানিক নেতা হতে হবে যার গবেষণা নিয়ে, সুযোগ নিয়ে, পৃথিবীর নতুন প্রযুক্তি নিয়ে ভালো ধারণা থাকবে। শিক্ষার্থী বান্ধব হতে হবে যেমন, ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ইন্টার্নশিপের জন্য ব্যবস্থা করে দিতে হবে।আর্থিক দায়বদ্ধতা তৈরি করতে হবে, প্রতি বছর প্রতিটি বিভাগের যা যা প্রয়োজন এগুলোর তালিকা করতে হবে। সকল মত,ধর্মের ও বর্ণের মানুষকে সমান ভাবে সম্মান করে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। সর্বোপরি, নতুন উপাচার্যের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার জায়গায় জিরো টলারেন্স হতে হবে।

শিক্ষার্থী বান্ধব উপাচার্য চান আদিল

আদিল রায়হান

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ৩য় বর্ষ শিক্ষার্থী আদিল রায়হান। তিনি বলেন, সোজাকথায় বলতে গেলে আমরা চুয়েটে একজন অভিভাবক চাই। যিনি শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের নয়, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থীর অভিভাবক হবেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ছায়া হবেন। হবেন মহীরুহ। চুয়েটে আসার পর থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশাসনকে আমরা শিক্ষার্থী বান্ধব হিসেবে পাইনি। সাধারণ দাবি থেকে শুরু করে এমনকি সড়ক আন্দোলনের চাওয়াগুলোও এজন্য অনেকটাই ব্যর্থতায় পর্যদুস্ত হয়েছে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবহেলিত হয়েছি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত দূর্বলতা, যানবাহন সমস্যা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর মতো বড় সমস্যাগুলো আমাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এসব ব্যাপারে অনেক শিক্ষক চেষ্টা করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথাযথ হস্তক্ষেপ না থাকায় বিষয়গুলো দিনকে দিন খারাপই হয়েছে। এমতাবস্থায়, নতুন উপাচার্য আসলে আশা থাকবে তিনি এসব সমস্যাগুলোর ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করবেন। পাশপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন সহ, শিক্ষা-গবেষণার মানোন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ, যথাযথ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। একসময় আমরা যেন গর্ব করতে পারি অনাগত উপাচার্যকে নিয়ে, ভবিষ্যতের ক্যাম্পাসকে নিয়ে। সেই কাঙ্ক্ষিত দিনের প্রত্যাশায় রইলাম।

উন্নয়নমনা উপাচার্য চান নুজহাত

নুজহাত জাহান

পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুজহাত জাহান। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ও আশা আকাঙ্ক্ষার জায়গা। আর সেই স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা অবর্ণনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের অগ্রগতির জন্য আমাদের উপাচার্য কেমন হওয়া চাই তা আমাদেরকেই ভাবতে হবে। একজন উপাচার্যের সর্বপ্রথম লক্ষ্য ও দায়িত্ব হওয়া প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন। একজন উন্নয়নমনা উপাচার্যই পারবেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীদের বিকাশ ও মননের আদর্শ স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, প্রতিটি ক্লাসরুমকে আধুনিকায়ন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে শিক্ষার্থীবান্ধব করা সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মানোন্নয়ন সাধনের মনোভাব থাকতে হবে আমাদের ভিসির মাঝে।এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করে আমাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য কাজ করার উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের নতুন উপাচার্য মহোদয়কে। শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ ও প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি দলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত পক্ষপাতহীন একজন যোগ্য ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন উপাচার্যই এখন সময়ের দাবি।

গবেষণাপ্রেমী উপাচার্য চান তামিম

আশরাফুল আলম তামিম

ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম তামিমকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কেমন উপাচার্য চাই, এর উত্তরে সবার প্রথমেই আসলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর উন্নতি এবং একাডেমিক থেকে শুরু করে দাপ্তরিক সংস্করণে আগ্রহী এমন কেউ যাতে আমাদের মধ্যে আসেন। একাডেমিকভাবে আমরা যাতে কোন ভাবেই পিছিয়ে না থাকি বরং অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি আদর্শ তৈরী করতে পারি তার মনোভাব পোষণ করেন। গবেষণাকে স্নাতক পর্যায় থেকেই ভালোভাবে প্রচার করার নিমিত্তে যিনি কাজ করবেন আমরা তাকেই উপাচার্য হিসেবে চাই। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে শিক্ষার্থী,শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারী সকলের অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করাটাও উপাচার্য নির্ধারণের একটি প্রধান মানদন্ড হওয়া উচিত। একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সাথে সাথে হাতে কলমে শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করাটা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই নতুন উপাচার্যকে অবশ্যই এই বিষয়েও মনোযোগ দিতে হবে। সর্বোপরি, একাডেমিক থেকে শুরু কাঠামোগত উন্নয়ন এবং ছোট ছোট বিষয়গুলোতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরীতে যিনি ভূমিকা রাখবেন তিনি অবশ্যই একজন যোগ্য উপাচার্য হবেন বলে মনে করছি।

বিচক্ষণ উপাচার্য চান সুরাইয়া

সুরাইয়া পারভীন

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সুরাইয়া পারভীন বলেন, উপাচার্য হচ্ছেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব । বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষক ,গবেষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা এসব কিছু উপাচার্যের কাজের মধ্যে পড়ে। তাই একজন যোগ্য উপাচার্যের সান্নিধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন সকল শিক্ষার্থীদের কাম্য। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত চুয়েটের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরাও একজন যোগ্য ব্যক্তিকে উপাচার্য পদে দেখার ইচ্ছে পোষণ করি। আমরা মনে করি একজন উপাচার্যের উনার নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা উচিত। ভালো সেন্স অফ হিউমার থাকা উচিত। বৈশ্বিক চিন্তা করে আঞ্চলিক প্রয়োগ করার দক্ষতা থাকা উচিত। তার অধীনস্থ ডিন, পরিচালক বা বিভাগের প্রধানদের সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার মত উনার জ্ঞানের পরিধি থাকা উচিত। একজন উপাচার্যের সকল শিক্ষার্থীদের প্রতিকূল অবস্থা বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দক্ষতা থাকা উচিত। সর্বোপরি একজন বিচক্ষণ, শিক্ষার্থীবান্ধব ব্যক্তিত্বকে চুয়েটের উপাচার্য হিসেবে আমারা সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *