মো:তানভীর আহমাদ:
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) গতকাল ১৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় “জুলাই স্মরণসভা ২০২৫”।
গত বছরের জুলাই মাসে শত শহীদের জীবনের বিনিময়ে দেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানের একবছর পূর্তিতে আয়োজিত হয় এই অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় আয়োজিত এই স্মরণসভায় উঠে আসে আন্দোলনের দিনগুলোর লোমহর্ষক স্মৃতি, আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে অটল থাকার অভিজ্ঞতা এবং অর্জনের মুহূর্তগুলো নিয়ে আগামীতে দেশকে নিয়ে তাদের আকাঙ্খার গল্প।
এই স্মরণসভায় শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেন।লাশের মিছিল থেকে বেঁচে ফিরা কিংবা আন্দোলনে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ভয়ে রাস্তায় কিংবা চা এর দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা লুকিয়ে থাকার মতো ঘটনা উঠে আসে তাদের বর্ণনায়। কেউ সরাসরি রাজপথে ছিলেন, কেউ বিভিন্নভাবে আন্দোলনের অংশ ছিলেন। সবার গল্পেই উঠে আসে সেই সময়কার সাহসিকতা, দৃঢ়তা এবং একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা।
অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক নুরুন নাহার জুলাই এর স্মৃতিচারণে অশ্রুসিক্ত হন সবাই এবং তিনি বর্ণনা করেন তখনকার সময়ে আইন প্রয়োগকারী প্রশাসন থেকে বিভিন্ন চাপ প্রয়োগের কথা।তিনি আরও বলেন,জুলাই ফিরে এলো, শ্রাবণে ফাগুন আনা আবাবিল পাখিগুলোতো আর ফিরে এলো না। জুলাই শুধু বিপ্লব নয়, জুলাই বিস্ময়, জুলাই কান্না, জুলাই বেদনা , জুলাই আমার বীর সন্তান হারানোর। গত ১৫ বছর কি বৃথা যৌবন পার করলাম! কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো বিরক্তি নেই, কোনো চিৎকার নেই। যারাই প্রতিবাদ, বিরক্তি, চিৎকার করেছে তারাই হারিয়ে গেছে। গুম হয়েছিল বাংলার আকাশ, ক্ষয়ে গিয়েছিল মানবতা, শুকিয়ে গিয়েছিল কলমের দুঃসাহসিক কালি। আমার সোনার ছেলেরা রক্ত দিয়ে সেই শুকনো কলমগুলো পূর্ণ করে নীরব হয়ে গেলো।”রক্তে আগুন লেগেছে” শ্লোগানে মাথার তালু থেকে পায়ের তালু অবধি রক্তের গরম স্রোত বয়ে গিয়েছিল, শরীরের প্রতিটি লোমকূপ বিদ্রোহে জেগে উঠেছিল, বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃদপিণ্ডের কপাটিকা খুলে চট করে বয়স ৪০ থেকে ২১ শে এসে থেমেছিল। রক্তের কালি দিয়ে হরফে হরফে পংক্তি লিখা হলো, রাজপথ কাঁপিয়ে শ্লোগান উঠলো, পিপীলিকার স্রোতের মতো মানুষ নেমে এল ভয়ের বাঁধন খুলে। জুলাই ফিরে ফিরে আসবে, ছেলেগুলো তো আর ঘরে ফিরবে না। জুলাইয়ের কান্নায় আজো কাঁদি। কি অসাধারণ সাহসী সন্তান জন্ম দিয়েছেন বীর প্রসবিনীরা। ধন্য তোমাদের জঠোর, ধন্য তোমাদের জন্ম, ধন্য তোমাদের সন্তানেরা।
অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহি আব্দুল্লাহ বলেন,জুলাইয়ে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় সবাই নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই প্রত্যেকের নিজস্ব চোখে দেখা জুলাইয়ের এক একটা আত্মকাহিনী আছে। আজকের এই জুলাই স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা আমাদের সহপাঠী, বড়ভাই, ছোটভাই ও শিক্ষকদের দুঃসাহসীক গল্পগুলো শুনার সুযোগ পাই। আমার মনে হয় জুলাইকে এবং এর আকাঙ্ক্ষাকে আমাদের মাঝে ধরে রাখার জন্য এবং যে উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে এতো এতো শাহাদাত ও রক্তের বলিদান হয়েছে জুলাইয়ে, সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং তা সমুন্নত রাখতে এমন আয়োজন ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়াও একই বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাইজুল কবির আবরার বলেন,বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জুলাই অভ্যুত্থানকে ঘিরে এরকম একটি আয়োজন করার জন্য।প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জুলাই স্পিরিটকে পৌছে দিতে সামনের দিনেও যেন এই ধরনের আয়োজন অব্যহত থাকে।
এসময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে আরও বক্তব্য রাখেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ৪র্থ বর্ষের আতফান বিন নূর ,তড়িত ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী তাহমিদুল ইসলাম সামিন ও ইশফাক আহমেদ জীম।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রকল্যাণ অধিপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুল আলম। তিনি সমাপনী বক্তব্যে বলেন,জুলাই অভ্যুত্থানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেভাবে জীবন দিয়েছে,তাদের কাছে দেশ ও দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থেই ঋণী।আগামীর বাংলাদেশেও যেন কোনো বৈষম্য না থাকে।
চুয়েট স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদের ইমাম মাওলানা হামিদুল্লাহ কোরআন তিলাওয়াত এর মাধ্যমে প্রোগ্রাম শুরু হয় এবং শেষাংশে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত, যেখানে আন্দোলনের সাহসী অংশগ্রহণকারীদের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।