জিওন আহমেদ
বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের সাথে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সময়ের সাথে সাথে যুগোপযোগী করে নিচ্ছে । কারণ বিশ্বায়নের গতিবিধি নির্ভর করে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর । আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ । তাই বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চাই নন্দিত উপাচার্য । তবেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উন্নত যুগোপযোগী করতে পারবো ।
কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রেক্ষাপট ভিন্ন । দলীয় আনুগত্য ও লেজুড়বৃত্তির শিরোপাস্বরূপ উপাচার্যের পদে অভিষিক্ত হয়ে বাংলাদেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ পেয়ে নিজেদেরকে উপাচার্য থেকে সিইও ভাবতে শুরু করেন । এর মাঝেও যখন আমরা স্বপ্ন দেখি- তখনই নতুন নতুন কর্তৃত্ববাদী আচরণে যখন কোনো উপাচার্য নিন্দিত হন, তখন আমাদের সেই আশা ভরসা আর থাকেনা ।
দৈনিক যায়যায় দিন পত্রিকায় ‘দুর্নীতি হচ্ছে তাই বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে: কুবি উপাচার্য’ এই শিরোনামে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের জের ধরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এবং দৈনিক যায়যায় দিন পত্রিকা প্রতিনিধি ইকবাল মনোয়ারকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ঐ শিক্ষার্থী উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈনের বক্তব্য ‘বিকৃত’ করে প্রকাশিত হয়েছে।
উপাচার্য দাবী করেন- “কন-টেক্সট বাদ দিয়ে উদাহরণ নিয়ে একাডেমিকের ভাষায় বলা কথা এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যাতে মনে হচ্ছে আমি দুর্নীতির পক্ষে বলেছি। প্রতিবাদ-লিপি দিয়েছি তাও ছাপেনি। মৌখিকভাবে ভুল স্বীকার করলেও নিউজ সরানো হয়নি। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে” ।
উপাচার্য কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সহ সোশাল মিডিয়ায় বলেছেন, ‘তিনি দুর্নীতিকে উৎসাহিত বা একে ইতিবাচক-ভাবে উপস্থাপন করেননি, বরং শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং নিয়ে উৎসাহিত করার জন্য উদাহরণস্বরূপ কিছু কথা বলেছেন।’
এই ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং নিয়ে তার বক্তব্যে তিনি বলেন- “অনেকেই বলে দেশে দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন হচ্ছে না। কিন্তু আমি বলব উল্টো কথা। দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে। এটা নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন কথা বলতে পারে। যে ঘুষ খায়, সে পদ্মা পাড়ে যায় ইলিশ খেতে। এতে পদ্মা পাড়ের গরীব মানুষেরা ধনী হচ্ছে। দুর্নীতি এভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখে। তাই অর্থনীতিবিদগণ দুর্নীতি কখনো কোনো বিরূপ মন্তব্য করে না। তবে যারা পলিটিকাল ইকোনমিক নিয়ে কাজ করে তারা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে থাকে। নৈতিকতার জায়গায়ও এটি প্রশ্নবিদ্ধ। তবে অর্থনীতির জায়গা থেকে যদি বলি, দুর্নীতি কখনোই উন্নয়নের জন্য বাঁধা নয়।’
তার অর্থ এই দাঁড়ায়, মানুষ দুর্নীতি করে বেশি টাকার ব্যাগ ভর্তি বাজার করবে, আর তাতেই দেশের উন্নতি হবে ।

এই যদি হয় একজন উপাচার্যের ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং, তবে সেটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। যার ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এর এই অবস্থা, তিনি নিজের এথিকসে কতটা ইতিবাচক সেটা বুঝতে বাকি থাকেনা । তিনি বলতে পারতেন, স্লিপ অব টাং হয়ে কিছু ‘উল্টাপাল্টা’ কথা বলে ফেলেছেন। এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতেন। তিনি সোজা পথে না হেঁটে উল্টো পথে হেঁটেছেন। ফলস্বরূপ ‘বিকৃত’ বক্তব্য প্রকাশের অসত্য অভিযোগ এনেছেন । সেই সাথে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংবাদ প্রকাশকারী সেই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছেন।
ইকবাল মনোয়ার দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। তাঁর সংবাদে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে নিয়মতান্ত্রিক পথে বক্তব্য তুলে ধরতে পারতেন। তা না করে ইকবালের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা একজন উপাচার্যের আচরণ এবং নৈতিকতার সাথে যায় না । উপাচার্য যা বলেছেন, সেই উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ করে ইকবাল মনোয়ার তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে তিনি কোনো অন্যায় করেননি। বরং কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে ইকবালকে বহিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।

এখানে উপাচার্য যে আচরণ করেছেন তা দেখে তাকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য মনে হয়নি, বরং মনে হয়েছে- তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইও ।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রেরিত নোটিশ এবং বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে জানা যায়, এই সংবাদ প্রকাশের পর প্রক্টরিয়াল বডি ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। পরে উপাচার্যের নেতৃত্বে প্রভোস্ট, ডিনসহ পদস্থ সবাইকে নিয়ে এক সভায় ওই সুপারিশ অনুমোদন করা হয়। এরপর বহিষ্কারের চিঠি দেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রক্টরিয়াল বডি সুপারিশ করলেই কাউকে সরাসরি বহিষ্কার করা যায় না। নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় তা উপস্থাপন ও অনুমোদন হওয়ার পর সিন্ডিকেটে তা তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে এসবের কিছুই করা হয়নি।
তাহলে উপাচার্যের সেই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা কি করছিলেন ? নাকি তারাও উপাচার্যের হ্যাঁ তে হ্যাঁ আর না তে না বলেই সভা শেষ করেছেন?
একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত ছাড়াই একের পর এক শিক্ষার্থী বহিষ্কার করে খেয়াল-খুশিমতো আচরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হওয়া যায় না। বরং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে চেয়ারের মর্যাদা রক্ষা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে যদি কোনো শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের প্রয়োজন হয়, সেটাও নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপায়ে উচিত ছিল ।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের এই আচরণ একইসাথে দেশের নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশকে চরমভাবে আঘাত করেছে । এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি সহ বিভিন্ন সংস্থা যখন প্রতিবাদ-লিপি সহ মানব-বন্ধন পালন করছে, তখন উপাচার্য নিজের বক্তব্যকে সমর্থন করে বিভিন্ন সোসাল মিডিয়া সাফাই গাইছে । যা একইসাথে স্বৈরাচারীতা এবং একজন উপাচার্য হিসেবে লজ্জাজনক ।
লেখক
সাবেক সভাপতি, চুয়েট সাংবাদিক সমিতি