বিজ্ঞানে নারীর যত অবদান। ফিচার

সম্রাট চৌধুরী ঃ

আমাদের সমাজে ধারণা হচ্ছে যেকোন জিনিসই তো পুরুষ আবিষ্কার করে, পুরুষ তৈরি করে, পুরুষরাই এমন কাজ করে, নারীরা নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন ধারণা আমাদের মনে পাকাপোক্তভাবে গেঁথে গেছে বহুকাল আগে থেকেই। আমরা ধরেই নিই, বিখ্যাত সব জিনিসের পেছনে রয়েছে একজন পুরুষের অবদান। অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়- এমন অনেক কিছুর আবিষ্কার ও সেই জিনিসটি তৈরির পেছনে নারীদের ভূমিকা ছিল, যা আমরা জানতেই পারিনি।

এমন কয়েকটি পরিচিত জিনিসের নারী আবিষ্কারকদের এখানে তুলে আনা হলো ঃ

ডিএনএ মডেল

ডাবল-হেলিক্স ডিএনএ মডেলের উদ্ভাবক হিসেবে জেমস ওয়াটসন ও ফ্র্যাঞ্চিস ক্রিক এর কথা সবার জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে যে নামটি আজ থাকার কথা ছিল, যিনি মূলত এই মডেলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, তাকে আমরা অনেকেই চিনি না। ফিজিক্যাল কেমিস্ট রোসালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন একটি মেশিনের ডিজাইন করেন। ১৯৫২ সালে এই মেশিনটি এমন একটি ছবি তোলে যা ডিএনএ’র আকারের প্রমাণ দেখায়। যা ‘Photograph 51’ হিসেবে সুপরিচিত।

ফ্র্যাঙ্কলিনের সহকর্মী উইলকিনস ছবিটি ওয়াটসন ও ক্রিককে ছবিটি দেখান। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে তাদের কাজের সঙ্গে উক্ত ছবিটিও প্রকাশ পায়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৫৮ সালে ওভারিয়ান ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ফ্র্যাঙ্কলিন এবং ১৯৬২ সালে দুইজন পুরুষ বিজ্ঞানি ওয়াটসন ও ক্রিক নোবেল পুরষ্কার পান।

কম্পিউটার প্রোগ্রামিং

প্রখ্যাত কবি লর্ড বাইরনের কন্যা অ্যাডা লভালেইস (১৭) উদ্ভাবক চার্লস ব্যাবেজের বন্ধু ছিলেন। চার্লস ব্যাবেজকে বলা হয় কম্পিউটারের জনক। অ্যাডা তার শিক্ষকের জন্য একটি ফ্রেন্স আর্টিকেল ভাষান্তর করার সময় নিজের জন্যে বেশ কিছু নোট যোগ করেন, যা মূল আর্টিকেলটির তিনগুন ছিল।

১৮৪৩ সালে কম্পিউটারে চিঠি ও নাম্বার ব্যবহারের জন্য কোড কীভাবে কাজ করে, সেই সম্পর্কিত তার কাজের উপরে একটি বই প্রকাশিত হয়। সেই সাথে অ্যাডা লভালেইস ইতিহাসের পাতায় প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবে নিজের নামটি স্থায়ী করে ফেলেন।

উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারস

উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারস ছাড়া কোন গাড়ি কল্পনা করা যায় কি? কিন্তু প্রথম যখন এই অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গটি আবিষ্কার করা হয়েছিল, তখন সবাই এই জিনিসটিকে অপ্রয়োজনীয় ও অলাভজনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল! ১৯০৩ সালে একজন নারীর আবিষ্কার বলে কথা! নিউ ইউর্কের অ্যালাবামাতে বসবাসরত ম্যারি অ্যান্ডারসন একজন ট্রলি ড্রাইভারকে তুষারপাতের মাঝে গাড়ি চালানোর সময় দেখেন। তুষারের দরুন যার বারবার গাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ির সামনের কাঁচ পরিষ্কার করতে হচ্ছিল। তখন তিনি কাঠ ও রাবারের তৈরি লম্বা হাতলের মতো জিনিস তৈরি করেন। যা গাড়ির কাঁচ থেকে তুষার ও বৃষ্টির পানি সরিয়ে দেবে। সেটাই আজকের দিনের উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারস।

ডিশওয়াশার

অনেকেই হয়তো ভাববেন ডিশওয়াশার আবিষ্কারের আইডিয়াটি এসেছে ক্লান্ত ও হতাশাযুক্ত কোন নারীর কাছ থেকে, যিনি ঘরের কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। আদতে বিষয়টি একেবারেই উল্টো। ডিশওয়াশার তৈরির ধারণাটি এসেছে বিত্তবান পরিবারের কন্যা জোসেফিন কোক্রেইন এর কাছ থেকে। চাকরদের অনবরত থালাবাসন ধোয়ার বিষয়টি তাকে ভাবায়। তাদের কষ্ট কমাতে কিছু একটা করার তাগিদ থেকেই জোসেফিন তৈরি করেন মোটস চালিত ডিশওয়াশার।

হোম সিকিউরিটি সিস্টেম

১৯৬০ সালে নার্স ম্যারি ভ্যান ব্রিটেন ব্রাউন একা বাসায় থাকতে ও বাসা খালি রেখে কোথাও যেতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। নিজে নার্স ও স্বামী ইলেক্ট্রেশিয়ান হওয়ার ফলে দুজনের সময় মিলতো না বললেই চলে। তখন দুজনে ম্যারির আইডিয়া অনুযায়ী তৈরি করে নতুন ধরণের সিকিউরিটি সিস্টেম। যার মাধ্যমে ক্যামেরার সাহায্যে বাসা ও বাসার সামনের অংশের ছবি অন্য একটি টিভি স্ক্রিনে সরাসরি দেখা যেত। এছাড়া টু-ওয়ে অডিও ইকুয়েপমেন্ট বাসার বাইরে থাকা আগুন্তকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও করে দিতো।

ইনজেকশন সিরিঞ্জ

ডায়াবেটিস,হেপাটাইটিস, টাইফয়েডসহ অনেক চিকিৎসায় ইনজেকশন হলো আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু ছোটবেলায় আমরা শুধুমাত্র এই সিরিঞ্জের ভয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে পালাতাম। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বর্তমানে অনেক ব্যবহৃত একটি সরঞ্জাম হচ্ছে ইনজেকশন সিরিঞ্জ। ১৮৯৯ সালে একজন নারী বিজ্ঞানী লেটিটা গির ইনজেকশন সিরিঞ্জ আবিষ্কার করেন। এটি এমন একটি সিরিঞ্জ যা কেবল মাত্র এক হাত দিয়েই ব্যবহার করা সম্ভব।

বিদ্যুতচালিত রেফ্রিজারেটর

বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য একটি যন্ত্র হলো আধুনিক বিদ্যুতচালিত রেফ্রিজারেটর। ১৯১৪ সাল থেকে যন্ত্রটির ব্যবহার পুরো বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে। আর এই আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছেন একজন নারী, তিনি হলেন ফ্লোরেন্স পারিপার্ট। শুধুমাত্র বিদ্যুতচালিত রেফ্রিজারেটর নয়, বরং সেইসাথে ১৯০০ সালে রাস্তা পরিষ্কার যন্ত্র নির্মাণের একটি প্যাটেন্টও লাভ করেন যা পরবর্তীতে বাজারজাত করতে সক্ষম হন।

পেপার ব্যাগ মেশিন

সুবিধাজনক, সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব ব্যাগ হচ্ছে পেপার ব্যাগ। আর যেটির মাধ্যমে পেপার ব্যাগ বানানো যায় সেই মেশিনটি আবিষ্কার করেছিলেন মার্গারেট নাইট নামের আরেকজন নারী উদ্ভাবক। কিন্তু চার্লস অ্যানান নামক একজন বিজ্ঞানী মার্গারেটের এই আবিষ্কার কিছুতেই স্বীকার করতে নাজুক ছিলেন। কেননা চার্লস অ্যানান মার্গারেটের এই আবিষ্কারকে নিজের বলে চালিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। যার কারণে মার্গারেটকে প্রতিনিয়ত তার সাথে নানা তর্ক-বিতর্কের মুখোমুখি হতে হতো। একজন নারী বিজ্ঞানী কীভাবে বিস্ময়কর এই আবিষ্কার করতে পারেন, তার বিপক্ষে ছিলেন চার্লস। কিন্তু জয়ী হয়েছিলেন নারী বিজ্ঞানী মার্গারেট নাইট। তিনি ১৮৭১ সালে এই প্যাটেন্ট লাভ করেন। আর সেই সমালোচক চার্লস হারিয়ে গেছেন কালের গহবরে।

দ্য ফায়ার স্কেপ

কোনো একটি বিল্ডিংয়ের আট তলায় হঠাত্ আগুন লাগলে নিরাপত্তা সেবার অভাবে আগুন মুহূর্তের মধ্যে পুরো বিল্ডিংয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেই আগুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি ডিভাইস ব্যবহার করা হয়, যেটি ফায়ার স্কেপ নামে পরিচিত। এই ফায়ার স্কেপের আবিষ্কারকও একজন নারী। ১৮৮৭ সালে একজন নারী বিজ্ঞানী অ্যানা কোন্নেলি ফায়ার স্কেপ আবিষ্কার করেন।