উচ্চশিক্ষার ইতিকথা -দ্বিতীয়পর্ব: গবেষণায় চুয়েট এবং উচ্চশিক্ষা

বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে চুয়েটনিউজ২৪ এ লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যয়নরত সায়েদুল মোরসালিন।

 

[dropcap]প্র[/dropcap]থমে ক্ষমা চেয়ে নিই চুয়েটের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কাছে, কারণ আমার এই লেখাটা কারো কাছে ভালো না লাগতেও পারে।

যা হোক শুরু করি, একটি পরিসংখ্যান দিয়ে। www.scopus.com এর উপাত্ত অনুযায়ী  ২০০৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই একযুগে চুয়েটের সর্বমোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৩৮৪টি । অন্যদিকে রুয়েট, কুয়েট এবং বুয়েটের সর্বমোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৫৬, ৮৭৫ এবং ৬০৮২ টি । তার মানে চুয়েট অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় গবেষণার দৌড় প্রতিযোগিতায় অনেক দূর পিছনে । এবার আসি রাঙ্কিংয়ে । ব্যক্তিগত প্রয়োজনে চুয়েটের রাঙ্কিং লিখে একদিন Google এ Search দিলাম । সার্চ দিয়ে নিজের লজ্জায় নিজেই মারা যাই । যেসব রাঙ্কিং এর ওয়েবসাইট পেলাম সবজায়গায় দেখি চুয়েট শুধু রুয়েট, কুয়েটের তুলনায় শুধু পিছিয়ে নেই, পিছিয়ে আছে আহসানউল্যাহ, ব্র্যাক, নর্থ সাউথ এমনকি ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে। বিশ্বাস না হওয়ায় নিজের মনকে শান্তনা দিলাম সবগুলো ওয়েবসাইট ভুয়া। খুজতে থাকলাম কোন Authenticated সাইট । হতাশ হলাম যখন এরকম একটি Authenticated সাইট www.4icu.org ্ওয়েবসাইটে চুয়েটের রাঙ্কিং দেওয়া আছে ৭০৬২ এবং তা সমস্ত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে । আর বুয়েটের কথা বাদ দিলাম এমনকি কুয়েটও সেই রাঙ্কিংয়ে চুয়েটের তুলনায় দূরের ধ্রুবতারা । না কষ্ট না শুধু একবুক হতাশা। বিশ্বাস হচ্ছে না একবার Google Search দিয়ে দেখুন । কেন এরকম, আসুন কিছু কারণদর্শাই ……

১. Dynamicity

শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি, আমাদের চুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষক Dynamic নন। জানি না চুয়েটের বর্তমানে কোন ফ্যাকাল্টি আছেন কি না, যার উচ্চশিক্ষা World এর 50 ranking এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা । যাঁরা মাষ্টার্স করেছেন অধিকাংশের ডিগ্রি পাওয়া মালয়েশিয়া, কোরিয়া হতে এমনকি কেউ কেউ চুয়েটে । পিইচডি ডিগ্রি করা শিক্ষকের সংখ্যাও অপ্রতুল। Dynamicity  কম থাকার কারনে অনেক শিক্ষককেই জানে না বিশ্বায়নের যুগে গবেষণা কোন অবস্থানে আছে । পুরো চুয়েট খুজলে হাতেগোনা ২-৩ জন পাওয়া যাবে যাঁরা আমেরিকা, কানাডা এবং অষ্ট্রেলিয়া কিংবা জামার্নী থেকে পিএইচডি অথবা মাষ্টার্স করে আসছেন । আর নাই বলে চুয়েটের গবেষণাপত্রের মানও সেইরকম । কষ্টের ব্যাপার  হল ২০০৩ সাল থেকে চুয়েট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও চুয়েট একটি আন্তজার্তিক মানের কনফারেন্স আয়োজন করতে পারি নি (দয়া করে ICMERE এর উদাহরন দিবেন না) ।  আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, চুয়েটে খুজলে অনেক প্রভাষক পাওয়া যাবে তাঁদের কোন গবেষণাপত্র নেই এমনকি কিভাবে গবেষণাপত্র লিখতে হয় তাই জানে না, যেহুতু তারা নিজেরা জানে না তাই প্রশ্ন রইল তারা কিভাবে স্টুডেন্টদের এই ব্যাপারে সহযোগিতা করবে ? জানি না শিক্ষকদের কয়জন স্টুডেন্টদের Motivated করেছেন যে আমেরিকা এবং অষ্ট্রেলিয়ায় আসতে হলে এই ব্যাপারগুলো করতে হয়, এই Procedure গুলো follow করতে হয় ?

যা হোক, আশার কথা হলো গত তিন-চার বছরে চুয়েট শিক্ষকদের মালয়েশিয়া, কোরিয়ার পরিবর্তে USA, Australia, Europe তে আসা সংখ্যাতীতভাবে বেড়েছে ।

২. LED এর বাতি জ্বালানোঃ

চুয়েটের গবেষণা মানে LED এর বাতি জ্বালানো । শেষবর্ষের অধিকাংশ প্রজেক্ট হলো মাইক্রোকন্ট্রোলারের। আউটপুট আসলেই শেষ। দেখা যায়, ছেলেরা প্রজেক্টে পার পাওয়ার জন্য RMA, ASSRO এর শরণাপন্ন হয়  কিংবা শহর থেকে বানিয়ে নিয়ে আসে । এসব মাইক্রোকন্ট্রোলারের কাজ দিয়ে কখনও কোন ভাল মানের গবেষণাপত্র লেখা যায় না । ফলে গবেষণা গবেষনার জায়গায় থেকে যায় আর খুব কম সুপারভাইজার আছেন যাঁরা যুগোপযুগী টপিক দিয়ে ছাত্রদেরকে ব্যবহার করতে পেরেছে । আর যাঁঁরা ব্যবহার করেছেন তাঁদের অনেকের চাওয়া এত আকাশচুম্বী থাকে যে, ঐ ছাত্রটি কিছুদিন কাজ করার পর হতাশ হয়ে গবেষণা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । আমি আজ পরিষ্কারভাবে বলি  Undergrad-এ একজন ছাত্র কি এত মেধাবী হয়ে গেছে সে বিশাল কিছু করে ফেলবে? এই ভুল ধারণাটা কিভাবে আসে?

৩. শিক্ষক এবং ছাত্রের সম্পর্কঃ

একটি গবেষনাপত্র একজন শিক্ষক এবং একজন ছাত্রের যৌগমিলনের ফল । একজন সুপারভাইজার একজন ছাত্রকে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে, সেই পথে চলার জন্য নিরন্তন  Support দিতে পারে । কিন্তু চুয়েটে ঘটে ভিন্ন ঘটনা । এখানে সুপারভাইজার নির্ধারন হয় লটারির ভিত্তিতে । ফলে যে ছেলেটির  VLSI নিয়ে আগ্রহ, তাকে করতে হয় Power systems এ থিসিস । ফলে প্রথমেই তাদের মন থেকে গবেষনার ইচ্ছাটা উবে যায় । আর অন্যদিকে জানি না কয়জন সুপারভাইজার তার স্টুডেন্টকে প্রজেক্ট রিলেটেড গবেষণাপত্র Download করে দিয়েছেন?

৪. গবেষনাপত্রের Free Download:

চুয়েট থেকে প্রতিনিয়ত অনেক জুনিয়র Knock করে ভাইয়া এই Paper টা Download করে দেন, এই বইটা নামাইয়া দেন । আমি যখন স্টুডেন্ট ছিলাম আমিও তাই করতাম । এটা যে কত লজ্জার ব্যাপার অথচ একটু সহযোগিতা করলে ব্যাপারটা কিভাবে ভালো হত তা বলি :

যতদূর জানি চুয়েট লাইব্রেরীতে ২-৩ টা পিসি আছে যেখানে Research Paper Download করার Free  Access আছে । এই সংখ্যাটা যদি বাড়ানো যেতো? কিংবা প্রত্যেক Department এ যদি এরকম তিনটা Computer থাকতো তাহলে সেখানে স্টুডেন্টরা খুব সহজে লগইন করে মনের মত নিজের পছন্দমত গবেষণাপত্র Download করতে পারবে । এক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন প্রশাসনের সহযোগিতা এবং সদিচ্ছা ।

৫. ইমেইল আইডি:

একটি ইমেইল আইডি একজন উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী শিক্ষার্থীর অনলাইন  পরিচায়ক । ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি , বর্তমানে আমি Macquarie University এর স্টুডেন্ট বলে  ‍ওরা আমাকে একটি ইমেইল আইডি  দিয়েছে: sayidul.morsalin@students.mq.edua.au

যদি চুয়েটের প্রত্যেক স্টুডেন্টকে এরকম একটা ইমেইল আইডি দেওয়া হত: firstname.lastname@students.cuet.ac.bd ,তাহলে স্টুডেন্টদের বাহিরে মেইল চালাচালিতে অনেক বেশি সুবিধা পেত এবং তার সাথে একটা Authenticity থাকতো ।

৬. দেশের বাহিরে ফ্যাকাল্টি:

দেশের বাহিরে ফ্যাকাল্টি হিসেবে বুয়েট, কুয়েট প্রায়শ চোখে পড়লেও চুয়েটের সংখ্যা যেন ডুমুরের ফুল । আমি আমেরিকা, বা ইউরোপের কথা জানি না কিন্তু অষ্ট্রেলিয়ার কথা বললে, পুরো অষ্ট্রেলিয়া জুড়ে শুধু ১-২ জন মনে হয় চুয়েটিয়ান পেয়েছি যারা ফ্যাকাল্টি হিসেবে আছে । যার কারনে চুয়েটের লিংকটা বুয়েটের মত হায়ার স্টাডির ক্ষেত্রে এত দৃঢ় নয় ।

আজকের জন্য থামলাম, হয়তো আরো অনেক কিছু লেখা যাবে।

যা হোক, তৃতীয়পর্বে: উচ্চশিক্ষায় কেন অষ্ট্রেলিয়া, ‍স্কলারশিপের সুযোগসুবিধা এবং গবেষণা।
চতুর্থ পর্বে: কিভাবে প্রফেসরকে প্রেমপত্র লিখবেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: চুয়েটের রাঙ্কিং এবং গবেষনাপত্রের সংখ্যা, চুয়েটের দূর্বল একাডেমিক ব্যবস্থার পরিচায়ক । তাই এখানে শিক্ষক সমাজের কেউ যদি কিছু মনে করেন তাহলে আসলে কিছু করার নেই । যা হোক স্রোতের বিপরীতে চুয়েটে অনেক শিক্ষক আছেন যারা এখনও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন চুয়েটকে ভালো কিছু দেওয়ার জন্য। তাদের জন্য এখনও চুয়েট টিকে আছে । তাদেরকে কি বলে সম্মান জানাবো তার ভাষা আমার শব্দভান্ডারে নেই ।

এবং উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য PhD Scholar খিজির মাহমুদকে বিশেষ ধন্যবাদ ।

লেখক পরিচিতি :


Sayedul Morsalin Tushar

     সায়েদুল মোরসালিন

     Graduate Research Assistant

     Macquarie University, Australia.

 

 

 

 


 

তারিখ: ৭.৪.২০১৬